আমাদের দেশে শীতকালে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকি থাকে। এই সময় আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তন, ঠান্ডা বাতাস ও কুয়াশার কারণে মুরগি সহজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের মাত্রা বেড়ে যায় এবং যার ফলে খামারিদের ক্ষতি বা লোকসানের ঝুঁকি বাড়ে।
পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে যদি শীত শুরু হওয়ার আগেই মুরগিকে ভ্যাক্সিন দিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়, তাহলে তা খামার এবং খামারির জন্য অনেকাংশে লাভজনক হয়ে উঠে।
কেন শীতকালে মুরগির রোগ বেশি হয়?
শীতকালে পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে মুরগির দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যেসব মুরগি ঘরের বাইরে বা অর্ধ-ফার্ম পদ্ধতিতে পালিত হয়, তারা ঠান্ডার সংস্পর্শে এসে সহজেই নিচের রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়:
- নিউক্যাসেল ডিজিজ (Ranikhet)
- ইনফেকশাস ব্রঙ্কাইটিস
- ফাউল পক্স
- কক্সিডিওসিস
- ইনফ্লুয়েঞ্জা (Avian flu)
- ইনফেকশাস করাইজা
শুধু বড় মুরগিই নয়, বাচ্চা মুরগিদের মধ্যেও মৃত্যুহার বেড়ে যায়। তাই প্রতিরোধই হতে পারে সবচেয়ে ভালো সমাধান — এবং সেটা হল ভ্যাক্সিন।
মুরগির ভ্যাক্সিন কেন জরুরি?
ভ্যাক্সিন মূলত মুরগির শরীরে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এটি একটি ধরনের জীবাণু বা ভাইরাসের দুর্বল সংস্করণ যা মুরগির দেহে ঢুকে তাকে প্রস্তুত করে দেয় মূল রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য।
ভ্যাক্সিনের উপকারিতা:
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
- মৃত্যুহার কমে যায়
- খামারে উৎপাদনশীলতা বাড়ে
- ওষুধের খরচ কমে
- বাজারে মুরগির মান বজায় থাকে
কীভাবে মুরগিকে ভ্যাক্সিন দিতে হবে?
ভ্যাক্সিন দেয়ার পদ্ধতি নির্ভর করে ভ্যাক্সিনের ধরন ও কোম্পানির নির্দেশিকার উপর। নিচে কিছু সাধারণ নিয়ম দেওয়া হলো:
১। চোখে বা নাকে (Eye/Nasal Drop):
- সাধারণত লাইভ ভ্যাক্সিন (F1, IB) এইভাবে দেয়া হয়
- ভ্যাক্সিন ফোঁটা দেয়ার পর মুরগিকে ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখতে হয় যেন শোষণ সম্পূর্ণ হয়
২। পানিতে মিশিয়ে (Drinking Water):
- Gumboro বা Lasota এইভাবে দেওয়া হয়
- বিশুদ্ধ পানিতে মিশিয়ে ১-২ ঘণ্টায় খাওয়াতে হয়
- ভ্যাক্সিন দেয়ার আগে মুরগিকে কিছুক্ষণ না খাইয়ে রাখা উচিত
৩। ইনজেকশন (IM/SC):
- Marek’s, Cholera বা Coryza এর মতো ভ্যাক্সিন পেশিতে বা চামড়ার নিচে দিতে হয়
- প্রশিক্ষিত ব্যক্তি দ্বারা দিতে হবে
- জীবাণুমুক্ত ইনজেকশন সিরিঞ্জ ব্যবহার করুন
ভ্যাক্সিন সংরক্ষণের নিয়ম
ভ্যাক্সিন একটি সংবেদনশীল জৈব উপাদান। সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।
- ফ্রিজে ২°C থেকে ৮°C তাপমাত্রায় রাখুন
- সরাসরি রোদ বা তাপ থেকে দূরে রাখুন
- ব্যবহার করার আগে শুধু প্রয়োজনীয় পরিমাণ বের করুন
- একবার খুলে ফেললে পুনরায় ফ্রিজে রাখা যাবে না
শীতে খামারের বিশেষ যত্ন
ভ্যাক্সিন দেওয়ার পাশাপাশি শীতকালে নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে:
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ:
- খামারের ভিতরে তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখা আদর্শ
- দরজা-জানালা বন্ধ রাখুন ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষা পেতে
- রাতে গরম বাতি বা হিটার ব্যবহার করতে পারেন
মুরগির ঘরের পরিচ্ছন্নতা:
- খামার নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন
- বিছানা হিসেবে ধানের তুষ, খড় বা কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করে শুকনো রাখুন
- মুরগির খাবার ও পানির পাত্র জীবাণুমুক্ত করুন
মুরগিকে পর্যাপ্ত সুষম খাবার পরিবেশন:
- উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার দিন
- পানি সবসময় কুসুম গরম রাখুন এবং সম্ভব হলে সকাল বেলা আদা ও রসুন বাটা পরিমাণমত মিক্স করে দিন পানির সাথে
- ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট দিতে পারেন
মুরগি পালনে সচেতনতা জরুরি
অনেক খামারি ভ্যাক্সিনকে অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত খরচ বলে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো — প্রতিরোধ চিকিৎসার চেয়ে অনেক সস্তা ও কার্যকর। একটি রোগ ছড়িয়ে পড়লে সেটি পুরো খামারে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।
- সচেতন খামারি মানেই সফল খামারি।
“মুরগির ভ্যাক্সিন করিয়ে নিন শীতের আগে” — এটি শুধু একটি পরামর্শ নয়, বরং আপনার খামারকে নিরাপদ ও লাভজনক রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সময়মতো সঠিক ভ্যাক্সিন দিলে আপনি শীতকালে অনেক রোগ ও মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে পারবেন। খামারের উৎপাদনশীলতা বজায় থাকবে এবং বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ হবে।
আপনার খামারে ভ্যাক্সিন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সময়সূচি তৈরি করুন এবং প্রয়োজনে অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।