আমাদের দেশে পোলট্রি শিল্প বর্তমানে একটি সম্ভাবনাময় খাত। কিন্তু এই শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রোগ প্রতিরোধ। প্রতি বছর অসংখ্য খামার মুরগির বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে ক্ষতির সম্মুখীন হয় বিশেষ করে ছোট খামারি বা উদ্যোক্তরা। তাই মুরগিকে রোগমুক্ত রাখতে এবং খামারকে ঠিকিয়ে করতে ভ্যাক্সিনের ভূমিকা অপরিসীম।
ভ্যাক্সিন মূলত দুই ধরনের —
- লাইভ ভ্যাক্সিন (Live Vaccine)
- কিল বা ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাক্সিন (Killed / Inactivated Vaccine)
এই দুই ধরনের ভ্যাক্সিনই মুরগিকে রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, তবে কাজের ধরন, প্রয়োগ পদ্ধতি ও কার্যকারিতা ভিন্ন।
আজকের এই লেখায় আমরা বিস্তারিত জানবো —
- লাইভ ও কিল ভ্যাক্সিন কী,
- তাদের কাজের প্রক্রিয়া,
- পার্থক্য,
- ব্যবহার সময়,
- সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা।
ভ্যাক্সিন কীভাবে কাজ করে?
ভ্যাক্সিন আসলে মুরগির শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immunity) গড়ে তোলে।
এটি এমন একটি পদার্থ, যা শরীরে প্রবেশ করে “অ্যান্টিবডি” তৈরি করে — ফলে ভবিষ্যতে সেই রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে, দেহ তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
লাইভ ভ্যাক্সিন (Live Vaccine) কী?
লাইভ ভ্যাক্সিন হলো এমন ভ্যাক্সিন যেখানে জীবন্ত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে দুর্বল করে দেওয়া হয়।
এই জীবাণুগুলো আসল রোগ সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।
উদাহরণ:
- Newcastle Disease (F1, Lasota strain)
- Infectious Bronchitis
- Gumboro Disease (IBD)
- Fowl Pox
লাইভ ভ্যাক্সিনের কাজের পদ্ধতি:
- জীবিত কিন্তু দুর্বল ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে
- ইমিউন সিস্টেম সেটিকে চিনে “অ্যান্টিবডি” তৈরি করে
- ভবিষ্যতে একই ভাইরাস শরীরে এলে, দেহ দ্রুত প্রতিরোধ করে
লাইভ ভ্যাক্সিন প্রয়োগের পদ্ধতি:
- চোখে বা নাকে ফোঁটা (Eye/Nasal Drop)
- পানিতে মিশিয়ে (Drinking Water)
- কখনও স্প্রে আকারেও দেওয়া হয়
লাইভ ভ্যাক্সিনের সুবিধা:
- দ্রুত কাজ করে
- কম ডোজে কার্যকর
- স্বল্প খরচে দেওয়া যায়
- দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ দেয়
লাইভ ভ্যাক্সিনের সীমাবদ্ধতা:
- তাপমাত্রা সংবেদনশীল (ভ্যাক্সিন ঠান্ডা রাখতে হয়)
- ভুল প্রয়োগে রোগ ছড়াতে পারে
- দুর্বল বা অসুস্থ মুরগির জন্য উপযুক্ত নয়
কিল বা ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাক্সিন (Killed / Inactivated Vaccine) কী?
কিল ভ্যাক্সিন হলো এমন ভ্যাক্সিন যেখানে জীবাণুকে সম্পূর্ণভাবে মেরে ফেলা হয়, যাতে এটি রোগ সৃষ্টি করতে না পারে, কিন্তু শরীরে রোগ প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে।
উদাহরণ:
- Newcastle Disease (Killed type)
- Avian Influenza (AI)
- Fowl Cholera
- Coryza
কিল ভ্যাক্সিনের কাজের পদ্ধতি:
- মৃত ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে
- ইমিউন সিস্টেম সেটিকে বিদেশি উপাদান হিসেবে চিনে
- অ্যান্টিবডি তৈরি করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে
কিল ভ্যাক্সিনের প্রয়োগের পদ্ধতি:
- সাধারণত ইনজেকশন (IM বা SC – Intramuscular/Subcutaneous)
- বিশেষ করে প্রজনন বা ডিম উৎপাদনকারী মুরগির জন্য
কিল ভ্যাক্সিনের সুবিধা:
- নিরাপদ ও স্থিতিশীল
- রোগ সৃষ্টি করে না
- গর্ভধারণকারী মুরগিতেও ব্যবহারযোগ্য
- দীর্ঘমেয়াদে শক্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়
কিল ভ্যাক্সিনের সীমাবদ্ধতা:
- প্রয়োগে সময় ও দক্ষতা লাগে
- খরচ বেশি
- ধীরে কাজ করে
- বারবার বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে
লাইভ ও কিল ভ্যাক্সিনের মধ্যে পার্থক্য (Comparison Table)
বিষয় | লাইভ ভ্যাক্সিন (Live Vaccine) | কিল ভ্যাক্সিন (Killed Vaccine) |
---|---|---|
জীবাণুর অবস্থা | দুর্বল জীবন্ত ভাইরাস | মৃত ভাইরাস |
কাজের গতি | দ্রুত | ধীরে |
প্রতিরোধের স্থায়িত্ব | স্বল্পমেয়াদী কিন্তু কার্যকর | দীর্ঘমেয়াদী |
প্রয়োগ পদ্ধতি | পানিতে, চোখে, স্প্রে | ইনজেকশন |
সংরক্ষণ | ঠান্ডা তাপমাত্রায় জরুরি | তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল |
ব্যবহার সময় | ছোট মুরগি বা প্রথম পর্যায়ে | বড় বা প্রজনন পর্যায়ে |
রোগ সৃষ্টি ঝুঁকি | সামান্য থাকতে পারে | নেই |
খরচ | কম | তুলনামূলক বেশি |
দক্ষতা প্রয়োজন | কম | বেশি |
উদাহরণ | F1, Lasota, Gumboro | AI, Cholera, Coryza |
কোন ভ্যাক্সিন কখন ব্যবহার করবেন?
চিক বা বাচ্চা মুরগি (১ দিন থেকে ৪ সপ্তাহ):
লাইভ ভ্যাক্সিন সবচেয়ে কার্যকর, কারণ এটি দ্রুত রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
যেমন: Lasota, Gumboro, Fowl Pox
ডিম পাড়া বা প্রজননকারী মুরগি:
কিল ভ্যাক্সিন ব্যবহার করা উত্তম, কারণ এটি দীর্ঘস্থায়ী ইমিউনিটি দেয় এবং প্রজনন প্রভাবিত করে না।
যেমন: Avian Influenza, Coryza, Cholera
মিশ্র খামার:
দুই ধরনের ভ্যাক্সিনই প্রয়োজন — প্রথমে লাইভ, পরে কিল বুস্টার হিসেবে।
ভ্যাক্সিন সংরক্ষণের নিয়ম
- সব ভ্যাক্সিন ২°C থেকে ৮°C তাপমাত্রায় রাখতে হবে
- সরাসরি রোদে বা তাপে রাখবেন না
- বরফ বা কুল বক্স ব্যবহার করুন ভ্যাক্সিন বহন করার সময়
- মেয়াদোত্তীর্ণ ভ্যাক্সিন কখনো ব্যবহার করবেন না
ভ্যাক্সিন প্রয়োগে সতর্কতা
- ভ্যাক্সিন দেওয়ার আগে মুরগির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন
- অসুস্থ বা দুর্বল মুরগিকে ভ্যাক্সিন দেবেন না
- প্রতিবার জীবাণুমুক্ত সিরিঞ্জ ব্যবহার করুন
- নির্দিষ্ট ডোজ মেনে চলুন
- ভ্যাক্সিন দেয়ার পর ১-২ দিন পর্যবেক্ষণে রাখুন
কেন সঠিক ভ্যাক্সিন নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ?
ভুল ভ্যাক্সিন বা ভুল প্রয়োগের কারণে পুরো খামারে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সঠিক ভ্যাক্সিন নির্বাচন করলে আপনি পাবেন:
- কম রোগের ঝুঁকি
- উৎপাদন বৃদ্ধি
- ডিমের মান উন্নতি
- কম খরচে দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল
মুরগির কিল ভ্যাক্সিন ও লাইভ ভ্যাক্সিন — দুটিই গুরুত্বপূর্ণ, তবে ব্যবহার সময় ও উদ্দেশ্য ভিন্ন।
- ছোট মুরগির জন্য লাইভ ভ্যাক্সিন দ্রুত ও কার্যকর।
- বড় বা ডিম পাড়া মুরগির জন্য কিল ভ্যাক্সিন নিরাপদ ও স্থায়ী প্রতিরোধ দেয়।
তাই কোনো ভ্যাক্সিন ব্যবহার করার আগে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সময়মতো প্রয়োগ করুন।